• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

বরগুনার আলো
ব্রেকিং:
ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আগামীকাল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারকদের প্রতি আহ্বান রাষ্ট্রপতির আহতদের চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকর জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা চান প্রধানমন্ত্রী বিএনপি ক্ষমতায় এসে সব কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেয় চমক রেখে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করল বাংলাদেশ শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের ভিসা অনুমোদনের সময় বাড়ানোর আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ এআইকে স্বাগত জানায় তবে অপব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে ছেলেরা কেন কিশোর গ্যাংয়ে জড়াচ্ছে কারণ খুঁজে বের করার নির্দেশ প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর এসএসসির ফল প্রকাশ, পাসের হার যত ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্ররা পিছিয়ে, কারণ খুঁজতে বললেন প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর জলাধার ঠিক রেখে স্থাপনা নির্মাণে প্রকৌশলীদের আহ্বান প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে টেকসই কৌশল উদ্ভাবনের আহ্বান যে পরিকল্পনা হউক, সেটা পরিবেশবান্ধব হতে হবে : প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল থেকে উন্নয়নই আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য: প্রধানমন্ত্রী

বাংলা সাহিত্যে প্রথম সৈনিক-কাজী নজরুল ইসলাম

বরগুনার আলো

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২০  

চুরুলিয়া হলো বর্ধমান জেলার কয়লাখনি অঞ্চল। ইংরেজদের শাসনামলে এই গ্রামে আণ্ডাল থেকে চুরুলিয়া পর্যন্ত একটা রেলপথও চালু ছিল। ভারতের স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে এই রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়।

নজরুল তাঁর জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রাম থেকে এক সময় বেরিয়ে পড়েন। এই বেরিয়ে পড়া নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখার আগ্রহ নিয়ে। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন তিনি। ছোট পৃথিবী ছেড়ে বড় পৃথিবীর স্বপ্ন, লেখাপড়া শিখেছেন নানান স্কুলে। রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে, বর্ধমানের মাথরুন বিদ্যালয়ে। আবার বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কাজীর শিমলায় দরিরামপুর হাইস্কুলে। এসব তাঁর খাম-খেয়ালির মতো ব্যাপার ছিল না। আসলে যাঁরা বড় মাপের মানুষ হন, বিশেষ করে স্বপ্ন দেখা ভাবুক মানুষ তাঁদের ভিতরে অস্থিরতা থাকে। জীবনকে, দেশকে, জগতকে দেখার জন্য তাদের সব সময়ই মনে হয়, হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভুষণের মতো মানুষদের মধ্যেও এমনটা ছিল। পৃথিবীর অন্য অনেক বিখ্যাত লেখকদের জীবনেও এমনটা দেখা যায়। এ যেন তাদের এক স্বপ্নের দেশ, স্বপ্নের পৃথিবী খুঁজে বেড়ানো।

কবি নজরুল খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ধরাবাধা গতানুগতিক পথ যেন তার জন্য নয়। সিয়ারসোল হাইস্কুলে দশম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় বসার আগেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দেশের যারা যুবক তারা অনেক স্বপ্ন দেখতেন যে, বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হতে পারলে অস্ত্র চালনা শেখা যাবে। সেই অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা যাবে ভারতের ইংরেজ শাসকদের উপর। লেখা-পড়ার চাইতে তাঁরা তখন দেশ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। এসই স্বপ্নই তাঁকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কত কষ্ট করেছেন ঘর ছেড়ে বের হবার পর। কাজী বাড়ির ঠুনকো আভিজাত্য ভেঙে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। কিন্তু এসবের মধ্যেও ছেলেবেলার লেখা-পড়ায় দারুণ আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই আগ্রহেই ময়মনসিংহের মতো অতো দূরের এখনকার বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামে গিয়ে থেকেছেন। সেখানে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাও করেছেন।

নজরুল যদি যুদ্ধে যোগ না দিতেন তাহলে তাঁর জীবন কেমন হতো কে জানে। কিন্তু যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই তাঁকে সৈনিক কবি করে তুলেছিল। পৃথিবীর নানান দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ তাঁকে উৎসাহী করে তুলেছিল।

করাচির সেনানিবাসে থাকার সময় তিনি লেখেন প্রথম কবিতা ও গল্প। কলকাতার পত্রিকাতে তা ছাপা হয়। করাচিতে নজরুল ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার। এই যুদ্ধক্ষেত্রেই পল্টনের আরো দু’জনের সঙ্গে নজরুলের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ডিসিপ্লিন ইনচার্জ শম্ভু রায়। অন্যজন মণিভুষণ মুখোপাধ্যায়। এই মণিভূষণ পরবতীকালে ‘লাঙল’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। তাঁর আরেকটি প্রতিভা ছিল সংগীত প্রতিভা। মণিভূষণ নিয়মিতভাবে নজরুলের সঙ্গে সংগীতের তালিম নিতেন, এছাড়া আরো একজনের নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি হলেন হাবিলদার নিত্যানন্দ দে – যাঁর বাড়ি ছিল হুগলীর ঘু্টিয়া বাজারে। এই নিত্যানন্দের কাছ থেকেই নজরুল অরগ্যান বাজানো শিক্ষা গ্রহণ করেন।

নজরুলের জীবনে করাচি সেনানিবাসে থাকা এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সৈনিকের জীবন-যাপন করেও তিনি লেখাপড়া ও সাহিত্য চর্চায় নিয়মিত ডুবে থাকতেন। করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি তৎকালীন সমস্ত বিখ্যাত পত্র-পত্রিকা পাঠ করতেন। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, বঙ্গবাণী, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ও বিজলী’র গ্রাহক ছিলেন। এছাড়া রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত নানা পত্র-পত্রিকা তিনি নিজের হাতের কাছে রাখতেন সব সময়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত রুশ বিপ্লব নজরুলকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। রুশ বিপ্লব সম্পর্কে যাবতীয় পত্র-পত্রিকা নজরুল অত্যন্ত খুঁটিয়ে পড়তেন। জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকাতেও রুশ বিপ্লব সম্পর্কে অনেক খবরাখবর প্রকাশিত হতো। যদিও এদেশে তখনো অবধি কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেনি। ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সেনা বিভাগের কঠিন কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থেকেও ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ভারতের একজন হাবিলদার হয়ে কীভাবে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে এতটা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তা থেকেই কাজী নজরুলের স্বদেশচেতনা এবং বিপ্লবী মানসিকতার প্রকৃত ছবিটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

যাইহোক, সৈনিক থাকা অবস্থায় নজরুলের সাহিত্য-জীবনের উন্মেষ ঘটে। করাচি থেকেই তিনি নিয়মিত কলকাতার পত্র-পত্রিকাতে বিস্তর লেখা পাঠাতে থাকেন। তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে ছাপা হতেই বাঙালি পাঠক মহলে এই নতুন অসামান্য প্রতিরোধের বাঙালি কবির একটি স্বতন্ত্র জায়গা নির্দিষ্ট হয়ে গেল। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই কাজী নজরুলই প্রথম সৈনিক কবি। নজরুলের ‘মুক্তি’ শীর্ষক কবিতাটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ছাপা হয়। যতদূর জানা যায়, এটিই ছিল পত্রিকায় ছাপানো তাঁর প্রথম কবিতা। এরপর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন সংখ্যায় মাসিক ‘সওগাত’ প্রথমবর্ষ সপ্তম সংখ্যায় নজরুলের একটি গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। গল্প হলেও লেখাটি অনেকটা আত্মস্মৃতিমূলক। ‘মুক্তি’ কবিতাটি প্রকাশের পর নজরুলের সাহিত্য-সৃষ্টিতে যেন বাণ ডাকতে শুরু করে। একটার পর একটা গল্প, কবিতা, উপন্যাস তিনি লিখতে শুরু করেন। লিখলেন, ‘ব্যথার দান’ গল্প, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হলো। প্রকাশ হলো ‘হেনা’ গল্পটি। ‘ব্যথার দান’ গল্পে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে কবি নজরুলের চিন্তা-ভাবনা কোন স্তরে ছিল তার বিবরণ পাওয়া গেল। শুধু দেশপ্রেম নয়, নজরুল ইসলামের এই গল্পের ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতাও ফুটে উঠেছে। যা আমাদের বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক বলতে হবে। ‘রিক্তের বেদন’ গল্পটিও নজরুল ইসলাম করাচি সেনানিবাসে বসে লেখেন।

নজরুল ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কলকাতায় ফিরে ১৯২০ সাল থেকে কবিতা ও গান লিখে গোটা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি অন্যতম প্রিয় সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর।

সুভাষচন্দ্র বলতেন, ‘নজরুলের গান না শুনলে মনের মধ্যে জোশ তৈরি হয় না।’

নজরুল ছিলেন মানবতাবাদী লেখক। তিনি বলতেন, ‘এই উপমহাদেশের কোনো মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত ভেদাভেদ থাকা চলবে না। নারী ও পুরুষের মধ্যে চলে আসা হাজার বছরের ব্যবধান দূর করতে হবে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা না করলে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না।’

তিনিই প্রথম মানুষ, লিখিত আসরে উপমহাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা যাঁর মধ্যে উচ্চারিত হয়েছিল। মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই তিনি বাকহারা ও স্মৃতিশক্তিহীন হয়ে পড়েন। বাইশ তেইশ বছরের সাহিত্য সাধনা তাঁর। এর মধ্যেই উপমাহদেশীয় জীবনের যে মূল বাণী সেই বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্যসাধনের মন্ত্রটিকে তিনি চমৎকার  ‍কুশলতায় চিত্রিত করে তুলেছেন তাঁর কবিতা, গান, গল্প ও প্রবন্ধ ইত্যাদি অজস্র সৃষ্টির মাধ্যমে। বাংলা ভাষায় এত অধিক সংখ্যক সংগীত আর কোনো কবি সৃষ্টি করেননি। তিনি তাঁর ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘এই উপমহাদেশ শুধু হিন্দুর নয়, শুধু মুসলমানের নয়, খ্রিস্টানের নয়— এই উপমহাদেশ সব মানুষের মহা মানবের মহান তীর্থমাত্র।’

আজীবন তিনি মানুষের জয়গান গেয়েছেন-সকল রকম সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ ছিল অশান্ত। ধর্মের উগ্রতা সমাজের সকল ইতরতার বিরুদ্ধে উদার উদাত্ত কন্ঠে সাম্যের আহ্বান। তাই তাঁর শেষ পরিচয় তিনি বাঙালি মানবতার কবি।

বরগুনার আলো